বইয়ের শিরোনাম দেখে পাঠক বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন। মনে হতে পারে, এ বই ঢাকার নিছক ইতিহাস বা তাকে ঘিরে প্রচলিত কিংবদন্তির বিবরণ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আমাদের সে ধারণা ভাঙতে শুরু করবে অচিরেই।
মীজানুর রহমান তাঁর অননুকরণীয় গদ্যভাষ্যে যে গ্রন্থের জন্ম দেন, তাকে কোনো বিশেষণ বা পঙিক্তর ছকে সহজেই বন্দী করা যাবে না। বলা যাবে না এ বই শুধুই ঢাকার ইতিহাস, এ বই শুধুই ঢাকার স্মৃতিকাহিনি, শুধুই রম্যরচনা বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুচ্ছ, মিশেল ইউজিন দ্য মঁতেইন, ম্যাক্স বিয়ারবোম বা অলডুস হ্যাক্সলি সৃষ্ট ঘরানার অন্তর্ভূত রচনার অনুরূপ কিছু। না, তা নয়। ঢাকা পুরাণ, সত্যি বলতে কি একান্ত ব্যক্তিগত মতে, একের ভেতর তিন বা চার। কেমন সেটা?
এ বইয়ে প্রাসঙ্গিক সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস থাকলেও সিংহভাগ জুড়ে আছে অনুপম সাহিত্যিক আবরণ এবং রম্যগুণ, ঢাকা পুরাণ-কে যা একঘেঁয়ে হতে দেয়নি। উল্লিখিত গুণের সমাহারে রচিত এ বই এমন এক অভূতপূর্ব রসায়নে জারিত, যার পাঠ-আকর্ষণ দুর্বার হয়ে ওঠে। ফলে এ বই কোনোভাবেই নাজির হোসেনের কিংবদন্তীর ঢাকা, যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস কিংবা বুদ্ধদেব বসুর আমার ছেলেবেলা ও আমার যৌবন হয়ে ওঠেনি। হয়ে উঠেছে অন্য কিছু।
মোট ২৭টি উপশিরোনামে বিভক্ত এই বই চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের ঢাকাকে যেমন চেনাবে, তেমনি চিনতে ও জানতে সাহায্য করবে তুর্কি, মোগল ও নবাবি শাসনামলের ঢাকাকে তার রূপ-রস-গন্ধময় বৈশিষ্ট্যসমেত। প্রয়োজনে লেখক যেমন সুদূর স্মৃতি ও শ্রুতির আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনি মাঝেমধ্যেই তথ্যেরও। সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার। ফলে এ বই তথ্য ভারাক্রান্ত হওয়ার অবকাশ পায়নি। হালকা মেঘের ভেলায় চেপে এর লেখক আমাদের চোখের সামনে এমন এক ঢাকাকে তুলে ধরেছেন, যে ঢাকার প্রাচীনতার চিত্রটিকে এবং তার আধুনিকতা অভিমুখীন বিবর্তনকে তাঁর মতো করে এর আগে আর কেউ এতটা জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন বলে মনে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন কেবল জিন্দাবাহার ও অন্যান্য-খ্যাত শিল্পী পরিতোষ সেন; কিন্তু জিন্দাবাহার ও অন্যান্য তো কেবল পরিতোষের একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার বই। মীজানুর রহমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি স্মৃতি, শ্রুতি ও ঐতিহাসিক উপাত্তের সঙ্গে ব্যক্তিক স্মৃতিজাত অভিজ্ঞতার সমাহারে ঢাকা পুরাণকে এমন এক মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছেন, যা, এক কথায়, তুলনারহিত।
এক টুকরো নজির তুলে ধরে দেখা যাক, যেখানে তিনি ঢাকার একমাত্র লিফট সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন:…‘সদরঘাট মানেই আনন্দখনি। সুনসান বইপাড়া। আশুতোষ লাইব্রেরি, বৃন্দাবন ধর বুক অ্যান্ড সন্স, আলহামরা লাইব্রেরি—আরও কত সারিবদ্ধ নাম। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কিশোরের আত্মিক যোগাযোগ ঘটে এই তীর্থে এসে। শিশুসাথী, শুকতারা, কিশলয়, রামধনু, পাঠশালা প্রভৃতি শিশু পত্রিকার উষ্ণ সান্নিধ্য ঘটে, সান্নিধ্য ঘটে কিরীটী, সুব্রত, রাজু এবং বিমল কুমার ও সুন্দর বাবুর সঙ্গে আর দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক ও স্মিথের সঙ্গেও। এই পাড়াতেই ছিল ঢাকার সবচেয়ে উঁচু ভবন—চারতলা কুমিল্লা ব্যাংক, যেখানে ঢাকার একমাত্র লিফটটি বহু দেহাতির কাছে ছিল এক অপার বিস্ময়। এই আজব গাড়ি, যা শূন্যে ওঠে, আবার ধরিত্রীর বুকে নেমে আসে! কাছে থেকে দেখার লোভ হলে গোঁফওয়ালা লিফটম্যান কর্তৃত্বের সুরে বলত, “ভাগো ইধারসে।” অগত্যা (ঢাকার একমাত্র) ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখত মাথা উঁচু করে ওপরে উঠে যাওয়া লিফটকে আর চোখ বড় বড় করে বলত, “দ্যাহো দ্যাহো মনুর মা, আসমানের দিকে উঠবার লাগছে উড়াজাহাজের লাহান।” আবার নেমে আসতেই বলে উঠত, “বাপ্পুস রে, কেমুন মাছরাঙ্গার লাহান তরতরাইয়া নামল!”’
এ চিত্র বিংশ শতকের পাঁচের দশকের ঢাকার। এ রকমের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।
বস্তুত, লেখক মীজানুর রহমানের শব্দ চয়নে, বাক্যের বয়নে-গঠনে, সর্বোপরি, কথনভঙ্গির রম্য ও রসগুণে যে ঢাকা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সে এক প্রাণবান ঢাকা, নিজস্ব ঐশ্বর্যে মণ্ডিত ঢাকা।
শব্দ চয়নে তিনি অসম্ভব সতর্ক-সচেতন। এমন সব শব্দ তিনি এই বইয়ে ব্যবহার করেছেন, যেগুলো ঊনবিংশ শতকে প্রচলিত থাকলেও, বিংশ শতকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তেমন ব্যবহূত হয়েছে বলে মনে হয় না। অনেক দেহাতি শব্দ বা শব্দবন্ধ তিনি ব্যবহার করেছেন, যেগুলো অভিধানেও খুঁজে পাওয়া যায় না, একমাত্র ‘টুপভুজঙ্গ’ ছাড়া। তোলবোলে, জাটোপেকের দৌড়, চেটেনেটে, বওয়াটে পিলইয়ার, বাঘাহামা, বাউনি বাওয়া, ভুশুরি, উচক্কা, বটকেরা, খরপোড়-জাতীয় শব্দের কী মানে? আবার নতুন শব্দ তৈরি করার দিকেও তাঁর প্রবল প্রবণতা। যেমন—উদ্দান্ত, তেকেলে, দুধহাসি, টাপেটোপে, নষ্টচেতন, উপাংশুকথন। উদাহরণের শেষ নেই।
সত্যি বলতে, ঢাকা পুরাণ এক দুর্লভ প্রজাতির বই। গ্রন্থপ্রেমী প্রত্যেক বাঙালির ঘরে এই বই ঢুকে পড়ুক, এই সরল কামনা আমার।
0 Comment to "ঢাকা পুরান"
Post a Comment